ছবিঃ লীনা-তানভীর |
রিমান্ডে থাকা লীনা-তানভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ থেকে ফুলশয্যার অভিনব এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তারা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এও জানিয়েছেন, হানিমুন করতে খুব শিগগিরই তাদের নেপালের কাঠমান্ডু যাওয়ার পরিকল্পনাও ছিল।
শারীরিকভাবে সুঠাম তানভীর আহমেদ প্রান্ত লীনার চেয়ে বয়সে ১১ বছরের ছোট। তবু প্রেম বলে কথা। কথায় আছে- ‘প্রেমে মজিলে যাহা হয়।’ নিজের স্বামীকে খুন করে অল্পবয়সী প্রেমিক তানভীরকেও কোটিপতি বানাতে চেয়েছিলেন এই লীনা। বলেছিলেন, ‘তোমার জন্য সব করব। তুমি শুধু আমায় উদ্ধার কর। এই ‘কালা ব্যাটা’ (নিহত গিয়াস উদ্দিন) আমায় অনেক জ্বালিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তানভীর পুলিশের কাছে এসব তথ্য দিয়েছেন। তানভীর স্বীকার করেছেন, ‘মাঝেমধ্যেই আমি তাকে নিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যেতাম। আমরা প্রায় যেতাম সিএনজি নিয়ে লংড্রাইভেও। কিন্তু এসব করে শুধু সময় নষ্ট হচ্ছিল। আর আমার আকাক্সক্ষা ছিল লীনাকে অনেক কাছে পাওয়া। সেজন্য আমি ১৫ অক্টোবর লীনাকে বিয়ের পরই আমার বাসায় নিয়ে যাই। ওইদিন আমরা কাজীপাড়ায় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সরাসরি বাসায় গিয়ে দু’জনে অন্তরঙ্গ সময় কাটাই। বলতে পারেন, বিয়ের পর ওটাই ছিল বাসর।’
তানভীর পুলিশের কাছে লীনাকে খুব চতুর দাবি করে বলেন, ‘অন্তরঙ্গ মুহূর্তেও লীনা বলেছে তোমার জন্য সব করলাম। তুমি আমার জন্য কর।’ আর লীনার প্ররোচণায় গিয়াসকে হত্যার পরিকল্পনা তখনই তানভীরের মাথায় আসে। লীনার হাতের মুষ্ঠি ধরে তানভীর কথা দেয়, ‘কথা দিলাম- ও থাকবে না। শুধু তুমি আমি থাকব।’ তখন লীনা তাকে বলে, ‘গিয়াসকে হত্যার পর আমাদের একটা কাজ করতে হবে। তা হল কিছুদিন আড়াল হয়ে চলতে হবে।’ লীনা বলেছে, ‘সবাই তাকে সন্দেহ করে। তাই কাউকে বিষয়টি বুঝতে দেয়া যাবে না।’
মিরপুর থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তানভীর ও লীনাকে যখন মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তখন তানভীরের বন্ধু মুক্তকেও তাদের সামনে আনা হয়। এ সময় লীনাকে উদ্দেশ্য করে মুক্ত বলে ‘তোর জন্য আজ আমরা খুনি। তোর জন্য আমাদের মা-বাবা কাঁদছে। তোর জন্য আজ সমাজ ও পরিবার আমাদের ধিক্কার দিচ্ছে।’ এ সময় তানভীর মুখ নিচু করে চুপ মেরে থাকে। লীনা উত্তরে মুক্তকে বলে, ‘নগদ টাকা নিতে ভালো লাগছিল। নতুন টাকার বান্ডিল দিলাম খুনের জন্য। তোরা তো খুন করতে আমাকেও উৎসাহিত করেছিস। আজ আবার কথা উল্টাচ্ছিস?’ জিজ্ঞাসাবাদে তানভীর-লীনা দুজন মুখোমুখি হলে কেউ কারও দিকে তাকায়নি। একপর্যায় লীনা মাথা উঠিয়ে তানভীরকে বলে, ‘চিন্তা করো না বেঁচে থাকলে সংসার একদিন হবেই।’
তানভীর তখন অনুতপ্ত হয়ে বলছিল, খুনটা না করলেও পারতাম। তোমার জন্য আজ খুনি। আমার বন্ধুরা খুনি। তানভীর লীনাকে বলে, তুমি না বলেছিলে, কোনোভাবে কেউ বিষয়টি জানবে না। তাহলে পুলিশ কিভাবে জানল আমরা খুন করেছি? তুমি না আমায় কথা দিয়েছ- কোনোভাবেই কাউকে ঘটনা ফাঁস করবে না। আজ এই পরিণতির জন্য তুমিই দায়ী। ডাকাতির ঘটনা সাজাতে গিয়ে আজ তুমি আমাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করালে। তার চেয়ে তুমি আত্মহত্যার নাটক সাজাতে পারতে।’
গত রোববার রাতে মিরপুরের ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিনকে খুন করার পর যে নাটক মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিলেন নিহতের স্ত্রী লাবনী ইয়াসমিন লীনার সে পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের ফাঁদে। মিরপুর থানার ওসি সালাহউদ্দিন খান কৌশলগতভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন লীনাকে। তখন তিনি তাকে বলেন, দেখুন যে কোনো খুনে অপরাধীরা আলামত রেখে যায়। আর আপনার স্বামীকে যারা খুন করেছেন তারাও কোনো না কোনো আলামত রেখে গেছেন। আপনি এ ঘটনা পুরোপুরি জানেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে লীনা মিরপুর থানার ওসিকে তাকে বাঁচানোর শর্তে খুনিদের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য দেন। কিন্তু ওই তথ্য জানার পর লীনাকেই সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার দেখানো হয়।
ওসি মো. সালাহউদ্দিন খান সংবাদ প্রতিদিন২৪ অনলাইন ডটকমকে বলেন, তানভীর ও লীনা বিয়ের আগেও একাধিকবার তাদের বাসায় যাতায়াত করেন। বিয়ের আগে তাদের মধ্যে রীতিমতো যোগাযোগ হতো। একে অপরের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রী আদান-প্রদান করত বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন তারা। ওসি জানান, মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদেও লীনা-তানভীর, মুক্ত ও জিসান হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একে অপরকে দোষারোপ করে। এখন রিমান্ডে থাকাবস্থায় আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে।
এদিকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায় তানভীর আহমেদ প্রান্ত পুলিশকে জানায়, ১৫ অক্টোবর বিয়ের পরই সে লীনার আরও কাছাকাছি চলে যায়। স্ত্রী হিসেবে লীনাকে সব সময় কাছে পেতে গিয়াসকে খুনের পরিকল্পনা করে। আর এই পরিকল্পনার আসল সময়টি ছিল অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। বিয়ের দিন গোলাপি রঙের থ্রি-পিস পরিধান করেছিল লীনা। তানভীরের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা দু’জন বিয়ের পরই চলে যায় তানভীরদের বাসায়। সেখানে লীনা নামটি আর লীনা ছিল না, তার নাম দেয়া হয়েছিল ‘লামিয়া রোজী’। বিয়ের দিন মিরপুর ১০ নম্বরে প্রিপারটোরি গ্রামার স্কুলের সাইনোবোর্ড ঘেঁষা ‘মেঘ’ নামে একটি শোরুমের সামনে লীনা ও তানভীরকে বহন করা রিকশাটি মিনিটে দু’য়েকের জন্য দাঁড়ায়। তানভীর একটি কোমল পানীয় বোতল কিনে রিকশায় উঠে পড়ে। তারপর লীনাকে তাদের বাসায় নিয়ে যায়। তখন তানভীরের বাবা-মা বাইরে ছিলেন।
লীনা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, তানভীরকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তার নাম পুলিশকে বলতে চায়নি। কিন্তু কি আর করার, যখন নিজেই ফেঁসে গেলাম তখন আর তাদের রক্ষা করে লাভ কি। লীনা জানায়, স্বামীর ঘরে তার এতটুকুও সুখ ছিল না। সুখ খুঁজতে মরিয়া ছিল সে। পুরনো বন্ধুদের নিয়ে আড্ডাও দিত মাঝেমধ্যে। অনেকে আবার বিষয়টি ভালোভাবে দেখত না। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় তানভীরের মাধ্যমে সবকিছুর উপসংহার টানবে। তাই তানভীরকে সে বাসায় নিয়ে আসত। তানভীরের প্রচণ্ড আবেগকে কাজে লাগিয়েছে জানিয়ে লীনা স্বীকার করে, ‘তাকে ধনী বানাতে চেয়েছি। সুখী করতে চেয়েছি। শুনেছি সে তার দাদা রমজান আলীর টাকায় বিএন কলেজে পড়ালেখা করে।’ তার হাত খরচের টাকাও মাঝেমধ্যে লীনা দিত বলে স্বীকার করে।
লীনা জানায়, বিয়ের দিন তানভীর তাদের বাসার একটু দূরে এসে অপেক্ষা করে। তারপর দু’জনে কাজীপাড়ায় গিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করে। আর এ বিয়ের মূল কারণ ছিল, গিয়াসকে ‘শেষ করে দেয়া।’ কারণ তানভীর চেয়েছিল, বিয়ে করেই সে ভালোবাসার কঠিন একটা প্রমাণ দেবে।
এছাড়া তানভীর ও লীনা বিয়ের পর বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনাও করে। তাদের দু’জনের পাসপোর্ট তৈরির জন্য মিরপুরের ১০ নম্বরে থাকা পাসপোর্টে অফিসের কথিত দালাল আবিদ মিয়ার সহায়তাও নেয়। তানভীরের ইচ্ছে বিদেশে গিয়ে তারা ‘হানিমুন’ করবে।
তানভীরের মা চমন আক্তার সংবাদ প্রতিদিন২৪ অনলাইন ডটকমকে জানিয়েছেন, তিনি শুধু জানতেন তার ছেলে লামিয়া ফিরোজ নামে একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু এই লীনা যে সেই লামিয়া তা জানতেন না। তানভীরের চাচী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদ প্রতিদিন২৪ অনলাইন ডটকমকে বলেন, ঘটনাটি তিনি জানতেন। তানভীর একটি বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে। মেয়েটি তাকে ব্যবহার করছে প্রতারণার জন্য। বিষয়টি তিনি তানভীরকে বহুবার বলেছেন। কিন্তু সে চাচীকে পাত্তা দেয়নি।
লীনা ও তানভীরের অসম প্রেমের বিয়ের পর বেরিয়ে আসছে রগরগে এসব কাহিনী। কেউ কেউ বলছেন এ যেন বাংলাছবির বিশেষ কোনো জুটির (নায়ক-নায়িকা) অবিশ্বাস্য প্রেমকাহিনী। লীনা পুলিশের কাছে স্বীকার করে, তানভীরকে সে তার সন্তানদের কথা প্রথম গোপন করে। তারপর তাকে তার প্রেমে দিওয়ানা বানায়। আর তানভীর যখন তার প্রেমে অন্ধ, তখনই স্বামীকে হত্যা করার সুযোগ নেয়। মিরপুর থানা পুলিশের অভিযানকালে তানভীর এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করে, ‘খুন আরও পরে করলেও পারত। লীনা যে সুখের জন্য স্বামীকে খুন করতে বলেছে সেই লীনাকে সুখী করতে পারেনি তানভীর। বিয়ের পর তানভীর নিজের বাসায় আড়াই ঘণ্টা সময় দেয় লীনাকে। এ সময়ে গিয়াসকে খুনের কথা অন্তত ২০ বার বলেছে লীনা। লীনার স্বামী বাসায় আসতে দেরি করবে বলে তাকে জানালে, বিয়ের পরদিন লীনাদের বাসায় বিকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অবস্থান করে তানভীর।
ওইদিন লীনা তাকে হাত খরচের কিছু টাকাও দেয়। জিজ্ঞাসাবাদে অনুতপ্ত তানভীর বলেছে, তার জীবনের সব হিসাব ভুল ছিল। আর লীনা বলেছে, গিয়াসকে খুন করে সে তার ওপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়েছে। তানভীরকে বিয়ের পরপরই গিয়াসকে খুন করা ভুল ছিল জানিয়ে লীনা বলে, ‘আমার ওপর প্রচণ্ড দুর্বল ছিল তানভীর। আর আমি তাকে কাছে পেতে দ্রুত গিয়াসকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিই।’
No comments:
Post a Comment