ছবিঃ লীনা, প্রেমিক তানভীর ও তাঁর বন্ধুরা |
এক বছর আগে মোবাইল ফোনে লাবনী ইয়াসমিন লীনার সঙ্গে পরিচয় কলেজ পড়ুয়া তানভীর আহমেদের। পরিচয় গড়ায় প্রেমে। তখনও তানভীর জানতো না লীনা বিবাহিতা। এক সময় যখন বিষয়টি পরিষ্কার হয় তানভীরের কাছে তখন প্রেমিকা লীনার চাপে পড়ে সে। স্বামী গিয়াস উদ্দিনকে ছেড়ে তানভীরের সঙ্গেই থাকতে চান লীনা। তাই এক মাস আগে স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি।
প্রথম স্বামীকে তালাক না দিয়েই গোপনে তানভীরকে বিয়ে করেন লীনা। এরপর প্রমিককে দিয়ে স্বামী খুনের মিশন বাস্তবায়ন করেন তিনি। এজন্য মাত্র ৩০ হাজার টাকা খরচ করেন লীনা। তার প্রস্তাবে প্রেমিক তানভীর তার কলেজ পড়ুয়া দুই বন্ধু সাদমান ইসলাম মুক্ত ও আকিবুল ইসলাম জিসানকে হত্যার জন্য চুক্তিবদ্ধ করে। লীনার পরিকল্পনা অনুয়ায়ী গিয়াসের মাথায় আঘাত করে তানভীর। এরপর তিনজন মিলে মারধর করে পালিয়ে যেতে চায়। তখনও লীনার চাপে পড়ে তারা সোফার কুশন দিয়ে গিয়াসের নাক-মুখে চেপে মৃত্যু নিশ্চিত করে।মিরপুরের ঝুট ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন হত্যা মামলায় নিহতের স্ত্রী লীনার প্রেমিক তানভীর আহমেদ স্বীকারক্তিমূলক জবানবন্দিতে এমন লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বুধবার ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে গিয়াস উদ্দিন হত্যার আদ্যপান্ত বলেছে তানভীর। দুপুরে মহানগর হাকিম তসরুজ্জামানের আদালতে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার পর আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে গ্রেপ্তারকৃত লীনা, মুক্ত ও জিসানকে আদালতে হাজির করে পুলিশ সাত দিন করে রিমান্ডের আবেদন করে। আদালত তাদের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা সংবাদপ্রতিদিন২৪ অনলাইন ডটকমকে জানান, লীনার প্রেমিক তানভীর নৌবাহিনী কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। সে লীনার চেয়ে বয়সে ছোট। তানভীরের বন্ধু মুক্ত ঢাকা কমার্স কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র এবং জিসান সরকারি বিজ্ঞান কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। গত ১৫ অক্টোবর তানভীর আহমেদ ও লীনা কাজীপাড়ার কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে। এসময় লীনা তার বৈবাহিক অবস্থা গোপন করেন। একাদশ শ্রেণীতে অধ্যায়নত এক তরুণের সঙ্গে দুই সন্তানের জননীর এই বিয়ের সময় তাদের বন্ধু-বান্ধব বিষয়টি জানতো না। পরে তানভীর বন্ধু জিসান ও মুক্তকে ঘটনা জানিয়ে সহযোগিতা চায়। তানভীর প্রেমের জন্য প্রেমিকার চাপে হত্যার পরিকল্পনায় অংশ নেয়। আর তার দুই বন্ধু টাকা পাওয়া এবং বন্ধুর উপকারের কারণে এতে রাজি হয় বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে।
তদন্তকারীরা আরও বলেন, দাম্পত্য জীবনে সুখী ছিলেন না লীনা। এ কারণে আগে থেকেই স্বামী গিয়াস উদ্দিনকে ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। তবে হত্যার পরিকল্পনা করেন প্রেমে বাধা আসার পর। সম্প্রতি তার প্রেমিক তানভীরকে বাসায় নিয়ে গেলে স্বামী গিয়াসের কাছে ধরা পড়েন তিনি। ওই দিন গিয়াস লীনা ও তানভীরকে মারধর করেছিলেন।
জবানবন্দিতে তানভীর জানায়, সে মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ১৯ নম্বর নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাড়ির আবু সাইদ আজাদের ছেলে। তার বাবা দুই বছর আগে সৌদি আরব থেকে ফিরে এসে মিরপুর এলাকায় ব্যবসা করছেন। এক বছর আগে মোবাইল ফোনে লীনা সঙ্গে পরিচয় হয় তার। প্রথম মিরপুর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দেখা করে তারা। মাঝেমধ্যে রিকশায় একসঙ্গে মিরপুর এলাকায় ঘুরতো। মোবাইল ফোনে পরিচয়ের পর থেকে লীনা তার বিবাহিত জীবনের পরিচয় গোপন রাখেন। রিকশায় ঘোরাঘুরি করার সময় লীনার স্বামীর পরিচিত এক ব্যক্তি তাকে দেখে ফেলে। এ নিয়ে ওই দিন বাসায় স্বামী গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে লীনার কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এর তিনমাস পর দেখা করার জন্য লীনা তার বাসায় আসতে বলেন।
তানভীর স্বীকারোক্তিতে আরো জানায়, মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের ১৫ নম্বর লাইনের ১১নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় লীনা তার স্বামীর সঙ্গেই থাকতো। বাসায় গিয়ে ড্রইং রুমে বসে লীনার সঙ্গে গল্প করছিল তানভীর। তখন পর্যন্ত সে ভেবেছিল এটি লীনার বাবার বাড়ি। কিন্তু হঠাৎ এক ব্যক্তি (গিয়াস) ড্রইং রুমে প্রবেশ করেন। তানভীরকে দেখে তার সামনেই লীনার ওপর ক্ষিপ্ত হন এবং মোবাইল ফোনসেট কেড়ে নেন। তানভীরকেও মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেন ওই ব্যক্তি। এর কিছুদিন পর আবার গোপনে তানভীরের সঙ্গে দেখা করেন লীনা। সেদিন লীনাকে একটি মোবাইল সেট সিমসহ কিনে দেয় তানভীর। তখন তানভীরকে লীনা বলেন, তার জীবনের একটি কালো অধ্যায় রয়েছে। মা-বাবা তার অমতে গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে তাকে বিয়ে দিয়েছেন। তার দুই সন্তান রয়েছে। তবে তিনি আর গিয়াসের সঙ্গে সংসার করতে চান না। যে কোনো উপায়ে গিয়াসকে হত্যা করে তানভীরকে বিয়ে করবেন বলে লীনা জানান। তার নতুন জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা গিয়াস। গিয়াসকে তালাক দিয়ে তানভীরকে বিয়ে করলেও সারা জীবন তাকে জ্বালাবেন সাবেক স্বামী। তাকে সরিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তানভীর আরও জানায়, লীনার চাপাচাপিতে তারা ১৫ অক্টোবর কাজীপাড়ায় কাজী অফিসে পরিচয় গোপন করে বিয়ে করে। সেখানে তার অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল। বিয়ের পর দ্রুত গিয়াসকে হত্যার জন্য চাপ দিতে থাকেন লীনা। হত্যা মিশন শেষ করতে ঈদের আগে তানভীরের হাতে ৩০ হাজার টাকা দেন তিনি। তখন লীনা তানভীরকে বলেন, গিয়াসকে হত্যার করলে উজ্জ্বল নামে তার এক সাবেক প্রেমিক ফেঁসে যাবে। তানভীর ও লীনার কিছু হবে না। তার কথামতো তানভীর ঈদের পর মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ৪ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়ির সরকারি অবসরপ্রাপ্ত বিদ্যুৎ প্রকৌশলী আব্দুল লতিফের ছেলে মুক্ত এবং কাজীপাড়ার সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স কর্পোরাল মিজানুর রহমানের ছেলে জিসানকে ৩০ হাজার টাকায় হত্যার মিশনে অংশ নিতে চুক্তিবদ্ধ করে।
হত্যার বর্ণনা দিয়ে তানভীর জানায়, রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তিন বন্ধু লীনার বাসায় যায়। আগে থেকেই নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে রাখে লীনা। তার পরিকল্পনা ছিল, হত্যার পর নাটক সাজাবেন তিনি। একটু পরে লীনা তার স্বামীকে ফোন করে বাসায় মেহমান এসেছে বলে জানান। এজন্য পোলাও চাল ও কোমল পানীয় আনতেও বলেন। পরে লীনা তার দুই সন্তান ইশিকা ও নিহালকে ঘরের বারান্দায় রেখে দরজা বন্ধ করে দেন। রাত ১০টার দিকে গিয়াস ঘরে ঢুকলে লীনা বাইরে যাওয়ার দরজা বন্ধ করে দেন। এসময় তানভীর লাঠি দিয়ে গিয়াসের মাথায় আঘাত করে। এরপর জিসান ও মুক্ত মারধর শুরু করে। গিয়াস অচেতন হয়ে পড়লে তারা তিনজন বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় হঠাৎ গিয়াস নড়াচড়া শুরু করায় লীনা চিৎকার করতে থাকেন। তার মৃত্যু নিশ্চিত না করলে তাদের (তিনজনকে) ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দেন লীনা। সোফার কুশন এনে গিয়াসের নাক-মুখে চেপে ধরার নির্দেশ দেন। তারা কুশন দিয়ে চেপে ধরে গিয়াসের মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর জিসান ও মুক্ত বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
পরে তানভীর লীনার কাছ থেকে একটি বোরকা নিয়ে সেটা গায়ে দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। তিনজন মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে একত্রিত হওয়ার পর তানভীর তাদের দুই জনকে ১৫ হাজার টাকা দেয়। বাকি টাকা পরে দেয়া হবে বলে জানায়। এরপর হত্যায় ব্যবহৃত লাঠি, গ্লাভস ও পরনের গেঞ্জি ড্রেনে ফেলে বাসায় ফিরে তানভীর।
মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহ উদ্দিন খান সংবাদপ্রতিদিন২৪ অনলাইন ডটকমকে বলেন, ‘আমাদের কাছে দেয়া তানভীরের স্বীকারোক্তিতে হত্যার মোটিভ পরিষ্কার হয়েছে। তবে স্ত্রী ও দুই বন্ধুর বক্তব্যের মধ্যে অনেকটা অসঙ্গতি আছে। তাদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আর কেউ জড়িত ছিল কি না।’
No comments:
Post a Comment