দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও প্রকৌশলী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সবার কাছে আলোর ফেরিওয়ালা হিসেবেই পরিচিত। গুণী এই মানুষটি যেখানেই হাত দিয়েছেন সফলতা যেন তার পিছু ছাড়েনি। শিক্ষকতা, প্রকৌশল পেশা, নীতিনির্ধারণী– সব কিছুতেই দেশকে বহু কিছু দিয়েছেন।
বাংলাদেশের খ্যাতিমান এই প্রকৌশলী জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী আর নেই। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
তার আত্মীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবায়েত-উল-ইসলাম তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে জানান, সোমবার রাত ২টার দিকে ঘুমের মধ্যে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর ‘ম্যাসিভ হার্টঅ্যাটাক’ হয়। ভোর ৪টার দিকে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে ততক্ষণে পরপারে চলে যান এই অধ্যাপক।
দেশে গত কয়েক দশকে যেসব বড় বড় ভৌত অবকাঠামো হয়েছে, তার প্রায় সবই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করা এই পুরকৌশলী।
১৯৯৩ সালে যাদের হাত দিয়ে বাংলাদেশের ইমারত বিধি তৈরি হয়েছিল, জামিলুর রেজা চৌধুরী তাদেরই একজন। দেশের প্রথম মেগাপ্রকল্প বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে ৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। আর এখন পদ্মার ওপরে দেশের সবচেয়ে বড় যে সেতু তৈরি হচ্ছে, সেই প্রকল্পের আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্যানেলেরও নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন তিনি।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান নানা উন্নয়ন প্রকল্পেও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের দলপতি তিনি।
একুশে পদক পাওয়া এই শিক্ষককে ২০১৮ সালে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। আমৃত্যু তিনি এই পদে ছিলেন। একই সঙ্গে আমৃত্যু তিনি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ছিলেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী।
জামিলুর রেজা চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৫ নভেম্বর। সিলেট শহরে প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী ও হায়াতুন নেছা চৌধুরীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
বাবার বদলির চাকরির কারণে তার শৈশব কেটেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। প্রাথমিক শেষ করে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি হলেও পরে তার পরিবার ঢাকায় চলে আসে। প্রথমে নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও পরে সেইন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন।
ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তখনকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ)। ১৯৬৩ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করে দেশের সেরা এই প্রকৌশল বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা শুরু করেন।
১৯৬৪ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে চলে যান জামিলুর রেজা চৌধুরী। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করেন। ১৯৬৮ সালে সেখানেই পিএইচডি শেষ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘শিয়ার ওয়াল অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল অ্যানালাইসিস অব হাইরাইজ বিল্ডিং’।
পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে আবারও বুয়েটে অধ্যাপনা শুরু করেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। পদোন্নতির ধারায় ১৯৭৬ সালে হন অধ্যাপক।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বুয়েট থেকে অবসরে যাওয়ার পর ২০০১ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন। ২০১০ সালে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন।
বিশেষজ্ঞ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়েও সরকারের বিভিন্ন পরামর্শক প্যানেলে জামিলুর রেজা চৌধুরীর ডাক পড়ে। ২০০১ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রীর আইটি টাস্কফোর্সেরও সদস্য করা হয়।
পুরকৌশলের এই শিক্ষক নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটিতেও তিনি ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বহুতল ভবন নির্মাণ, স্বল্প খরচে আবাসন, ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নকশা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে ইমারত রক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি এবং প্রকৌশল নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৭০টি গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে তার।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে অবদানের জন্য ২০১৭ সালে সরকার তাকে একুশে পদক দেয়। ২০১৮ সালের জুনে আরও দুজন শিক্ষের সঙ্গে তাকেও জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করা হয়।
ওই বছরই জাপান সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরীকে সম্মানজনক 'অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান, গোল্ড রেইস উইথ নেক রিবন' খেতাবে ভূষিত করে। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশি তিনি।
দীর্ঘ এই পথযাত্রায় জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গী ছিলেন তার স্ত্রী সেলিনা চৌধুরী। তাদের মেয়ে কারিশমা ফারহিন চৌধুরীও একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, আর ছেলে কাশিফ রেজা চৌধুরী কম্পিউটার প্রকৌশলী।
অধ্যাপক শিবলী রুবায়েত-উল-ইসলাম জানিয়েছেন, পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মঙ্গলবার জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে বনানী গোরস্তানে তার বাবা-মায়ের কবরে শায়িত করা হবে।
সতর্কবাণীঃ এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং দণ্ডনীয় অপরাধ।
No comments:
Post a Comment