গ্রামগঞ্জে বাচ্চারা রাতে না ঘুমালে মায়েরা গল্প করতেন, ‘তাড়াতাড়ি ঘুমাও, না হলে ভূতো আসবে।’ মায়েদের ভাষায় ভূতো হলো ভূতদের রাজা। তেমনি দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে নৈতিক চরিত্র স্খলনের অভিযোগ উঠলে বলা হয়, ‘অমুক স্কুলে আরেক পরিমলের উদয়’।
কবি শেকসপিয়ার লিখেছেন, হোয়েন ক্যারেক্টার ইজ লস্ট, এভরিথিং ইজ লস্ট। ‘পরিমল’ শব্দটি এখন আর একটি নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন এ নাম দেশের যে কোনো অঞ্চলে চরিত্রহীন শিক্ষক বোঝাতে একটি সর্বজন স্বীকৃত উদাহরণ। আর এই উদাহরণ প্রচলিত গত কয়েক বছর ধরে।
২০১০ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান পরিমল জয়ধর। তখন সারা দেশেই শিক্ষকদের কোচিং করানোর প্রবনতা ছিল অত্যন্ত বেশি। এই কৌশল অবলম্বন করতেন পরিমলও। তিনি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কয়েকদিন পরেই কোচিং ক্লাস চালু করেন। এই ঘটনা ২০১১ সালের।
কিন্তু পরিমলের বিষয় বাংলা, তার উপর নতুন শিক্ষক। তাই কোনো শিক্ষার্থীই পাচ্ছিলেন না। শেষে শরণাপন্ন হন তৎকালীন অধ্যক্ষা হোসনে আরার। তিনিও অভিভাবক এবং প্রবীণ শিক্ষকদের এক রকম নির্দেশই দিলেন যেন পরিমলকে শিক্ষার্থী যোগাড় করে দেয়া হয়। ফলস্বরূপ পরের মাস থেকেই পরিমলের কোচিং ক্লাসে এক ডজন ছাত্রী হয়ে গেল।
আর আস্তে আস্তে পরিমলের পশুরূপ বের হতে থাকলো। ওই বছরের মে মাসের শুরু থেকে পরিমল জয়ধরের কোচিংয়ে ১০ জন ছাত্রী ব্যাচে পড়া শুরু করে। স্কুলের কাছেই পরিমল জয়ধর, বাবুল কুমার কর্মকার, বিষ্ণুপদ বারুই, বরুণচন্দ্র বর্মণ ও বিশ্বজিৎ চন্দ্র মজুমদার বাসা ভাড়া নিয়ে কোচিং করাতেন।
কিছুদিন পর পরিমল ভিকাররুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা দিবা শাখার দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেন এবং আপত্তিকর ছবি তোলেন। এ ঘটনা কাউকে বললে ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার এবং ছাত্রীটিকে হত্যার হুমকি দেন।
পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে যে মামলাটি হয়, তাতে উল্লেখ করা হয়, দিনটি ছিল ২০১১ সালের ২৮ মে। এ সময় ছাত্রীর নগ্নদৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করা হয়। পরে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে ১৭ জুনও ধর্ষণ করা হয়।
১৯ জুন বিষয়টি ওই ছাত্রী তার সহপাঠীদের জানায়। ২১ জুন শাখা প্রধান লুৎফর রহমানকে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি ঘটনাটি দেখবেন বলে আশ্বস্ত করলেও কোন পদক্ষেপ নেননি বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন।
২২ জুন শিক্ষার্থীরা পূনরায় শাখা প্রধানের কাছে বিষয়টি তুলে ধরে। এরপরও পরিমলের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় ২৮ জুন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে অধ্যক্ষের কাছে এ ঘটনার ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সূত্রে তখন জানা যায়, যৌন নিপীড়নের লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরও পরিমলের পক্ষ নিয়ে অধ্যক্ষ বলেছেন, মেয়েটি ভালো না। এ নিয়ে শিক্ষিকাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শিক্ষিকারা জুন মাসের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের কাছে পরিমল ও অন্যান্য অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচার ও অধ্যক্ষ হোসনে আরার অপসারণ দাবি করেন।
৪ জুলাই অধ্যক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগে ছাত্রীটি তার ওপর যৌন পীড়নের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়।
এরপর ৫ জুলাই এই যৌন পীড়নের খবর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে হতবাক হয়ে পড়েন বিবেকবান মানুষ। আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। লিখিত চিঠির পর আন্দোলন আরো জোরদার হয়। এ আন্দোলনে যোগ দেয় অভিভাবক ও বিভিন্ন সামাজিক ও নারী সংগঠনগুলো। এ ঘটনার পরপরই শিক্ষক পরিমল জয়ধরকে স্কুল থেকে বরখাস্ত এবং তার সহযোগী শিক্ষক বরুণচন্দ্র বর্মণ ও আবুল কালাম আজাদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া বসুন্ধরা শাখার ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে তার পদ থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
৫ জুলাই ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সিদ্ধেশ্বরী মূল শাখায় পরিচালনা পর্ষদ এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়। ওদিনই ছাত্রীর বাবা মাহমুদুল হক যৌন হয়রানির অভিযোগে রাজধানীর বাড্ডা থানায় মামলা করেন।
৭ জুলাই ভোর রাতে পরিমল জয়ধরকে কেরানীগঞ্জে তার বড় বোনের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
ভিকারুননিসার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে সরকার পরিমলের প্রশ্রয়দাতা অধ্যক্ষ হোসনে আরাকে পরদিন (বৃহস্পতিবার) সরাতে বাধ্য হয়। জ্যেষ্ঠ শিক্ষিকা আম্বিয়া খাতুনকে নতুন অধ্যক্ষ মনোনীত করা হয়। কিন্তু বিকেলে পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে সরকার ঢাকা জেলা প্রশাসক মহিবুল হকের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি এডহক কমিটি গঠন করে।
প্রতিষ্ঠানের গভর্নিংবডির দুটি অংশের বিরোধের কারণে কমিটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। ফলে বিষয়টি নিয়ে বির্তকের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনার দ্রুত সমাধানের জন্য শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন।
এদিকে গ্রেপ্তারের পর শিক্ষক পরিমল জয়ধর গুপ্তের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম শামীমা পারভীন এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন বাড্ডা থানার পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) এসএম শাহাদত হোসেন।
সে সময় পরিমল জয়ধর ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের কথা স্বীকার করেন। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষ হওয়ার একদিন আগেই তাকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে আনা হয়।
২০১৩ সালের ৭ মার্চ পরিমলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। পরিমলের পক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নেন অ্যাডভোকেট মাহফুজ মিয়া।
ওই বছরের ২২ আগস্ট ওই ছাত্রীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। এর আগে তার মায়ের সাক্ষ্য নেয়া হয়। মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ২৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
সর্বশেষ চলতি বছরের ১০ নভেম্বর মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ঢাকার ৪ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক সালেহ উদ্দিন আহমেদ ধর্ষণ মামলায় রায়ের জন্য ২৫ নভেম্বর (আজ) দিন ধার্য করেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই এই রায় জানা যাবে।
নানা নাটকীয়তা, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিক্ষোভ আর ধর্ষক পরিমল জয়ধরে গ্রেপ্তারের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে ভিকারুনন্নেসা স্কুল এন্ড কলেজের পরিস্থিতি। কিন্তু সবাই তাকিয়ে আছে এই রায়ের দিকে। কারণ এর মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গন ‘কলঙ্কমুক্ত’ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সতর্কবাণীঃ
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং দণ্ডনীয় অপরাধ।
No comments:
Post a Comment