মাদারীপুর প্রতিনিধিঃ আজ ১৯ মে রবিবার মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সেনদিয়া গণহত্যা দিবস। একাত্তর সালের ওই দিন রাজৈরের খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া, পলিতা, ছাতিয়ানবাড়ি ও খালিয়া গ্রামের দেড় শতাধিক মুক্তিকামী মানুষ প্রাণ রক্ষা করতে পার্শ্ববর্তী আখ ক্ষেত ও ঝোঁপ-জঙ্গলে পাকি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও এই গণহত্যা দিবস পালন বা স্মৃতি রক্ষার্থে কোন উদ্যোগ আজও গ্রহণ করা হয়নি। ফলে শহীদ পরিবারের সদস্য, স্বজন ও স্থানীয়রা তীব্র ক্ষোভ, অসন্তোষ ও স্বজনহারা ব্যথা বুকে নিয়ে এখনও ধুঁকে ধুঁকে মরছেন।
১৯৭১ সালের ১৯ মে বিকেল ৪টা থেকে ৫টা। পাকি বাহিনী লঞ্চযোগে গোপালগঞ্জ জেলার ভেন্নাবাড়ি ঘাটে নেমে চরচামটা এলাকা থেকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। সেখান থেকে পাকি বাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় নৌপথে গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর হয়ে রাজৈরের কদমবাড়ী এলাকায় গান বোট থেকে নেমে সড়ক পথে বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ করে আসছে এমন খবর পেয়ে খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া, পলিতা, খালিয়া ও ছাতিয়ানবাড়ি এলাকার শত শত নর-নারী তাদের শিশু সন্তান নিয়ে আখ ক্ষেতসহ বিভিন্ন ঝোঁপ জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। যারা বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাতে পারেনি তাদের ধরে নিয়ে যায় পশ্চিম সেনদিয়া ফকিরবাড়ির ভিটায়, সেনদিয়া বাওয়ালী ভিটায়, বারিকদার বাড়ির উত্তর বাঁশ বাগানে, শচীন বারিকদারের বাড়ির দক্ষিণ খালপাড় এবং ছাতিয়ানবাড়ির পুকুর পাড়ে কারও চোখ বেঁধে, কারও হাত-পা বেঁধে, বাবা-মায়ের সামনে সন্তানকে, আবার সন্তানের সামনে বাবা-মাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আবার কাউকে বুট দিয়ে লাথি মেরে ক্ষত-বিক্ষত করে আগুনে পুড়ে ও গুলি করে হত্যা করে। অনেককে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। দীর্ঘ সময় এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে নরপিশাচরা ফেরার পথে পশ্চিম সেনদিয়া গ্রাম দিয়ে যেতেই আখ ক্ষেতে মানুষের শব্দ পেয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। নিমিষেই প্রাণ হারায় শতাধিক মানুষ। এছাড়াও পাকি বাহিনীর দোসররা আখ ক্ষেত এবং ঝোঁপ জঙ্গলে তল্লাশি চালিয়ে মাটির গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ও ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্যে ৬টি স্পটে দেড় শতাধিক মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। নারকীয় এ তা-ব শেষে পাকি বাহিনী ও তাদের দোসররা চলে যাওয়ার পর গ্রামের অন্য লোকজন ও আত্মীয় স্বজন এসে ঝোঁপ জঙ্গল এবং আখ ক্ষেতের মধ্য থেকে লাশ উদ্ধার করে খালের পাশে ৬টি স্থানে দেড় শতাধিক মানুষকে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। এ সকল স্থানে মাটি খুঁড়লেই মাটির মধ্যে থেকে এখনও মাথার খুলি ও হাড়-গোড় বেরিয়ে আসছে।
১৯৭১ থেকে আজ ২০১৯ সাল। এরই মধ্যে কেটে গেছে ৪৮ বছর। গণসমাধিগুলো সংরক্ষণ বা শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে নেয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। নতুন প্রজন্ম পাকি বাহিনী ও তাদের দোসররদের এই নারকীয় ঘটনার স্মৃতি ভুলতে বসেছে। অজানা রয়ে গেছে মুক্তিকামী মানুষের মহান আত্মত্যাগের কাহিনী। টেকেরহাটের এক চিহ্নিত রাজাকার মহিউদ্দিন হাওলাদার (মনি হাওলাদার)-এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকি বাহিনী ও তাদের দোসররা ওই সব গ্রামের নিরীহ নর-নারী-শিশুকে হত্যা করে। সেনদিয়া গণহত্যার স্মৃতি স্মরণ করে স্থানীয় শহীদ পরিবারের সদস্যরা এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ২০০৯ সালের ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ ১৪১৬) সেনদিয়া গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন। ওই স্মৃতিস্তম্ভে ১২৬ জন শহীদের নাম সম্বলিত একটি স্টোন লাগানো হয়েছে। সেদিন গণহত্যার সময় পাকি বাহিনী ও তাদের দোসররা অমূল্য কুন্ডুর ঘরে আগুন দিয়ে ঘরসহ তার বৃদ্ধা মাকে পুড়িয়ে হত্যা করে। বৃদ্ধার নাম না জানার কারণে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে তার নাম খোদাই করা সম্ভব হয়নি। সেদিন শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধন করেন পোপালগঞ্জ খ্রীস্টান মিশনের তৎকালীন রেভারেন্ড (মিশনারি) বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা ফাদার মারিনো রিগন।
সতর্কবাণীঃ এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং দণ্ডনীয় অপরাধ।
No comments:
Post a Comment